শবে বরাত এর ফজিলত ও এ রাতে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার

শবে বরাত একটি ফার্সি শব্দ যার কারণে এই শব্দের ব্যবহার আরবিতে নেই। ফার্সিতে বরাত শব্দের অর্থ হল ভাগ্য, বণ্টন, নির্ধারিত। তবে শাবান মাসের গুরুত্ব রয়েছে। শাবান মাসের মধ্য তারিখের গুরুত্ব রয়েছে।

হাদিসঃ 

সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিস গ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়।
(হাদিসগুলোর সনদ বিভিন্ন মানের এবং এবিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান।) হাদিস শাস্ত্রে ‘শবে বরাত’ বলতে যে পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো( ليلة النصف من شعبان)
লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান” তথা “শা’বান মাসের মধ্য রজনী”। একটি হাদীসে বলা হয়েছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

[عَنْ أَبِي مُوسَى الأَشْعَرِيِّ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ ‏ “‏ إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلاَّ لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ ‏]

আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।
(ইবনু মাজাহ-১৩৯০),
হাদিসের মান হাসান
তাহক্বীক:আলবানী রাহিমাহুল্লাহ।

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে, মুহাম্মাদ সা: এ মাসে বেশি বেশি নফল নামাজ ওনফল রোযা পালন করতেন। শাবান মাসের রোযা ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
“এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালবাসি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।”
সূত্র:
*নাসাঈ ৪/২০১;
*সহীহুত তারগীব ১/২৪৭।
[সনদ হাসান]
তাহক্বীক:আলবানী রহ:।
*শবে বরাত : ফজিলত ও আমল।
ড.খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ:।

হাদিস অনুসারে এই রাত দোয়া কবুল, ক্ষমা প্রার্থনা সহ আল্লাহ’র কাছে চাওয়ার রাত। যথাঃ

عليه وسلم : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب الإيمان.

আলী বিন আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে সালাত পড় এবং এর দিনে সওম রাখ। কেননা এ দিন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর আল্লাহ পৃথিবীর নিকটতম আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, কে আছো আমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করবো। কে আছো রিযিকপ্রার্থী আমি তাকে রিযিক দান করবো। কে আছো রোগমুক্তি প্রার্থনাকারী, আমি তাকে নিরাময় দান করবো। কে আছ এই প্রার্থনাকারী। ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (তিনি এভাবে আহবান করেন)
তাহক্বীক্ব আলবানী: যঈফ.

সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৮৮

তাকি উসমানি দা:বা: বলেন, “এ কথা বলা একেবারেই ভুল যে, শবেবরাত কোন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং আসল সত্য হল, ১০ জন সাহাবি থেকে হাদিসগুলোয় নবী করীম (সা.) এই রাতের ফজিলত বর্ণনা করেছেন। সেই হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু হাদিস সনদের দিক থেকে যদিও কিছুটা দূর্বল। যার কারণে কয়েকজন আলেম বলেছেন এই রাতের ফজিলতের কথা ভিত্তিহীন। কিন্তু এর স্বপক্ষে অন্য অনেক হাদিস পাওয়া যায়। যার মাধ্যমে সেগুলোর দূর্বলতা দূর হয়ে যায়।

**এছাড়া শবে বরাত রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়।

হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন-

هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم.

‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩৮২-৩৮৩

ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-
هذا مرسل جيد

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শবে বরাত রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।

শবে বরাত রাতে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার:

শবে বরাত উপলক্ষে সমাজে প্রচলিত কতিপয় ভিত্তিহীন কাজ ও কুসংস্কার যেমনঃ 

১। গুনাহ মাফ হবে এমন আশায় শাবানের ১৪ তারিখের সূর্য্যাস্তের সময় গোসল করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক।

২। দান সদকা করা ভালো।কিন্তু হালুয়া রুটি এবং বিভিন্ন রান্নার আয়োজন করে ইবাদাতের পরিবেশ নষ্ট করা অন্যায়।

৩। এ রাতে ফটকাবাজি করা আনন্দ উল্লাস করা এ রাতের উদ্দেশ্যের বিপরীত এবং গর্হিত কাজ।

৪। বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এবং এ রাতকে একটি উৎসবের রাত মনে করে যাপন করাও এক ধরনের মানসিক বোকামি।

৫। বিভিন্ন পদ্ধতির নামাজ যেমন সূরা ফাতিহার পরে সূরা কাফিরুন তিনবার দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস তিনবার………. এভাবে বিশেষ বিশেষ সংখ্যায় নামাজ পড়ার নিয়ম প্রমানিত নয় সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মনগড়া।

৬। অনুরুপভাবে শবে বরাতের বিশেষ সংখ্যার কোন নামাজও নির্ধারন নেই। যেমন ৮ রাকাত ১২ রাকাত ইত্যাদি। তবে হ্যাঁ, প্রিয় নবীর তাহাজ্জুদ এর সংখ্যা সাধারনত ৮ রাকাত ছিল। এটি সারাবছরের আমল ছিল। বিশেষ কোন দিনকে কেন্দ্র করে নয়।

শবে বরাত এ আমাদের করণীয়:

1. যেহেতু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই রাতে সমস্ত সৃষ্টিকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন শুধুমাত্র হিংসুক এবং মুশফিক ব্যতীত তাই আমাদের শাবান মাসের সর্বপ্রথম এই আমলটা করতে হবে তথা শির্ক এবং হিংসা থেকে বেঁচে থাকা।
2. সাধারণ নিয়মে নফল নামাজ আদায় করা।
3. রমজান কিংবা শাবান মাসের সমনার্থে নফল রোজা করা যেহেতু রাসূল রোজা করেছেন। বিশেষ করে লক্ষ্য রাখতে হবে কোনভাবেই আমাদের রোজার নিয়ত যেন এমন না হয় যে আমরা শবে বরাতকে কেন্দ্র করে রোজা রাখছি।
4. বেশি বেশি ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা )করা।

শবে বরাত এর নামাজের নিয়ম

শবে বরাত এর নামাজ কত রাকাত?

শবে বরাত এর নামাজ ২ রাকাত করে পড়তে হবে। আপনি যত খুশি পড়তে পারেন।

শবে বরাত এর নামাজ এর নিয়ত কি?

শব ই বরাত এর নামাজ এর নির্দিষ্ট কোন নিয়ত নেই। আপনি নফল নামাজ আকারে পড়বেন। তবে চেষ্টা করবেন লম্বা কেরাত তেলওয়াত করার।

শবে বরাতের নামাজ কি নফল না সুন্নত?

শবে বরাতের নামাজ নফল। কিন্তু সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত।

লিখেছেনঃ 

📝 মাহমুদ বিন নুরুল আমিন।
তাকমীল: জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *