রমাযান সম্পর্কে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রঃ) এর জিজ্ঞাসা ও জবাব

রমাযান সম্পর্কে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রঃ) এর জিজ্ঞাসা ও জবাব| Ramadan 2023

সম্মানিত রোজাদার ও ভাই ও বোনেরা শুরুতেই আমার সালাম নিবেন।  আমরা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস অতিবাহিত করছি। পবিত্র রমাযান মাস সিয়াম সাধনার মাস, এই মাসে আমরা আমাদের সিয়াম সাধনাকে আরো সুন্দর ও পরিপূর্ণ করতে আপনার মনে জাগ্রত হওয়া রমাযান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এবং সেগুলোর সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছি। আজকে আমরা আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহ রচিত জিজ্ঞাসা ও জবাব বই থেকে রমাযান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর আলোচনা করব।

রমাযান সম্পর্কে আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রঃ) এর জিজ্ঞাসা ও জবাব

প্রশ্ন: রমাযান মাসে রোযা রেখে নথ-চুল কি কাটা যাবে?

উত্তর: বোন, উত্তর দেয়ার আগে একটু পেছনে যাই । রমাযানের রোযা কেন নষ্ট হয়। ইবাদত তো আপনার জন্য । আপনি যেন ইবাদতের মাধ্যমে সুন্দর মানুষ হন | আল্লাহ তাআলা পানাহার নিষেধ করেছেন । কাজেই পানাহার নয় এমন সবই করা যায় । নখ- চুল শুধু না, একটা হাত কেটে গেলেও রোযার কোনো ক্ষতি হবে না । আমরা অনেক সময় মনে করি, রক্ত বেরিয়ে গেলে রোযার ক্ষতি হয় । আসলে কিন্তু তা নয়। রাসূল (সাঃ) রোযা অবস্থায় নিজে চিকিৎসার জন্য শরীর ছিদ্র করে হিযামা (শিঙ্গা লাগিয়েছেন) করেছেন । কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, রক্ত বেরোলেও রোযা ভাঙে না, ইঞ্জেকশন নিলেও রোযা ভাঙে না । নখ-চুল কাটলে তো রোযা ভাঙার প্রশ্নই আসে না । রোযার কোনো ক্ষতিও হয় না।

প্রশ্ন: তারাবীহ নামাযের সময়সীমা কতটুকু? ইশার পর থেকে বারোটার ভেতরে শেষ করতে হবে নাকি বারোটার পরেও পড়া যাবে?

উত্তর: তারাবীহর সময়সীমা হল, ইশার পর থেকে ফজরের আগ পর্যন্ত । বরং যতো দেরি করে পড়া হবে ছওয়াব ততো বেশি হবে । উমার রা.এর যুগে মানুষ যখন প্রথম রাতে তারাবীহ পড়ত, তিনি বলতেন, শেষরাব্রে না ঘুমিয়ে তারাবীহ শেষরাত্রে পড়লে ছওয়াবটা বেশি হবে । কাজেই আপনি ফজরের আযানের পূর্বমুহূর্ত পর্যস্ত তারাবীহ পড়তে পারেন৷

প্রশ্ন: রোযা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে রোযার ক্ষতি হবে কি না?

উত্তর: অনিচ্ছাকৃত বমি হলে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। এমনকি মুখ ভরে বমি হলে বা রিপিটেড বমি হলেও রোযার ক্ষতি হবে না । তবে আল্লাহ না করুন, কেউ বমি খেয়ে ফেললে রোযার ক্ষতি হবে ।

সেহরি ও ইফতারের সময়সূচি 2023 – ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুযায়ী

প্রশ্ন: অনেকেই রোষা রাখে না । মদ খায়, অশ্লীল কাজ করে । তারাবীহর নামাযে এদের কুরআন শরীফ খতম করা জায়েয আছে কি না? হাফেয সাহেবরা তাদেরকে বলেন, রমাযানে তারাবীহ পড়লে, কুরআন খতম করলে জীবনের সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যায় । হাফেয সাহেবদের এসব বলা বন্ধ করা উচিত কি না জানাবেন ।

উত্তর: আমরা সবাই জানি রোযা না রাখা মহাপাপ । আর ইসলামে অন্যের কর্মে আরেক জনের মুক্তির কোনো সুযোগ নেই । আপনি স্বেচ্ছায়, মনের আগ্রহে যে পাপ করবেন সেটা আপনার পাপ । আবার যে পুণ্য করবেন সেটা আপনার পূণ্য । কাজেই তারা যদি এই পাপ থেকে তাওবা করেন, কোনো বান্দার হক থাকলে ফিরিয়ে দেন, আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে অনুতপ্ত হয়ে আর করবেন না সিদ্ধান্ত নেন- তাহলে ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ মাফ করবেন । আর যদি এই অবস্থায় তারা মৃত্যুবরণ করেন তাহলে ব্যাপারটা আল্লাহ তাআলার উপরে চলে যাবে ।

আর দ্বিতীয় কথা হল, ইসলামে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে যে, নেক আমলের মাধ্যমে পাপ মাফ হয় । আবার অন্যান্য আয়াত ও হাদীসে বলা হয়েছে অমুক অমুক গোনাহ কখনো মাফ হয় না অথবা তাওবা ছাড়া মাফ হয় না। আমরা অনেক সময় বলি সন্তানেরা মায়ের সব কথা শুনতে পারে না । কারণ মা সন্তানের এতো ভালো চান, প্রতি পদে তাকে গাইডেন্স দেন । ফলে সব মানা যায় না। কিছু ভুলন্রান্তি হয়ে যায় । এর জন্য কিন্ত্র মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় না।

ঠিক তেমনি আল্লাহ তার বান্দার এতো ভালো চান, তাকে অনেক রকম গাইডেন্স দিয়েছেন। এর ভেতর কিছু আছে পালন না করলে ছোট গোনাহ হয়। সেটা নেক আমল, রোযা, তারাবীহ, ওযু, পাচওয়াক্ত সালাত ইত্যাদি দ্বারা মাফ করে দেন । আর কিছু পাপ আছে বড় পাপ- কবীরা গোনাহ । এগুলো তাওবার মাধ্যমে মাফ হয়। আবার কিছু পাপ আছে যেটা বান্দার সাথে জড়িত । মদের গোনাহ তাওবায় মাফ হয়।

কিন্ত কারো গীবত করা হয়েছে, কারো হোটেলে খেয়ে টাকা দেয়া হয় নি- এটা ওই ব্যক্তি ক্ষমা না করলে পূর্ণ ক্ষমা হবে না।

প্রশ্ন: কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কারণবশত রোযা রাখতে না পারে, হয়তো তার কষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে কাফফারা দিলে কি আদায় হবে?

উত্তর: আসলে কষ্ট বলতে আপনি কী বোঝাচ্ছেন! কষ্টের মাত্রা রয়েছে। একটা হল আমার কষ্ট হচ্ছে। আরেকটা হল আমার শরীরের ক্ষতি হচ্ছে। সেরেফ কষ্ট্ের জন্য তো রোযা ছাড়া যাবে না । কিছু কষ্ট তো করতেই হবে । কষ্টের মাধ্যমেই আমাদের ইবাদত করতে হয় আমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্য। কষ্ট করে শরীরচর্চা না করলে মেদ হয়ে যায় । কষ্ট করে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ না করলে অসুস্থ হয়ে পড়ব । এই কষ্টের জন্য রোযা বাদ দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না ।

তবে যদি ক্ষতি হয়, রোগ বেড়ে যায়, অসুস্থতা আসে, সেক্ষেত্রে তিনি রোযা ছেড়ে দেবেন যদি সামনে ভালো হওয়ার আশা থাকে তাহলে রোযাগুলোর কাজা করবেন । না হলে প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন দরিদ্বকে দুই বেলা খাওয়াবেন৷ অথবা একটা রোযার জন্য একটা ফিতরা পরিমাণ খাদ্য বা অর্থ দরিদ্বকে দিয়ে দিবেন ।

প্রশ্ন: তারাবীহ না পড়লে রোযার কোনো ক্ষতি হবে কি না?

উত্তর: জি, না। রোযা রমাযান মাসের একটা ফরয ইবাদত | তারাবীহ রমাযান মাসের একটা সুন্নাত ইবাদত । দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ইবাদত ৷ একই মাসে আমরা করি | কেউ যদি তারাবীহ পড়তে না পারেন বা কম পড়েন অথবা একা পড়েন বা মোটেও না পড়েন এর জন্য রোযার কোনো ক্ষতি হবে না । তবে রমাযান মাসের একটা অত্যন্ত নেক আমল থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন।

প্রশ্ন: আমার প্রশ্ন হল, রোযা দশটা হলে আল্লাহর রহমতে আমি কুরআন খতম দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা হল বিশ পারা পর্যন্ত একটা ওয়ার্ড আমি ভুল পড়েছি। কিন্তু একুশ পারা থেকে আবার সেটা শুন্ধ করে নিয়েছি। এখন আমার জিজ্ঞাসা হল, এই কুরআন তিলাওয়াত থেকে আমার ছওয়াব হয়েছে নাকি ওই ভুল পড়ার কারণে গোনাহ হয়েছে?

উত্তর: আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের যত লেনদেন অথবা মুআমালাত আছে, এর ভেতর সবচে’ সহজ, আস্তরিক, প্রিয় লেনদেন হল আল্লাহ তাআলার সাথে । আল্লাহ তাআলা আপনার মনের আগ্রহ এবং সাধ্যমতো চেষ্টা দেখবেন । আল্লাহ তাআলা এমন কোনো মহাজন নন যে, উনিশ-বিশ হলেই আপনার পুরোটা কেটে দেবেন । এমন কোনো স্কুল শিক্ষকও নন । কাজেই আপনি সাধ্যমতো পড়েছেন এবং অনিচ্ছাকৃত যে ভুল হয়েছে এটা আল্লাহ ক্ষমা করবেন । আপনার খতম হয়ে গেছে । হয়তো ওই ভুলটা না করলে আপনার ছওয়াব আরেকটু বেশি হত । এই ভুলের জন্য ছওয়াব কিছুটা কমতে পারে । এটা ছাড়া আর কিছু নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না

প্রশ্ন: আমার স্বামী রমাযান এ একটি রোযা রেখেছে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে পরের রোযাগুলো আর রাখতে পারে নি। এক্ষেত্রে আমার স্বামীর করণীয় কী?

উত্তর: যদি কেউ অসুস্থতার কারণে রোযা রাখতে না পারেন, তিনি সুস্থ হওয়ার আশা থাকলে কিছুই করবেন না। সুস্থ হওয়ার পরে রোযাগুলো কাজা করবেন । এতে কোনো গোনাহ হবে না । আর যদি এমন অসুস্থ হন, সুস্থ হয়ে রোযা রাখার আশা আর না থাকে, তাহলে প্রতিটি রোযার বিনিময়ে একজন দরিদ্র মানুষকে দুইবেলা খাওয়াবেন। অথবা একটা ফিতরা সমপরিমাণ টাকা কোনো দরিদ্র মানুষকে দিয়ে দেবেন ।

প্রশ্ন: ঘুমের ভেতরে যদি কোনো অশ্লীল স্বপ্ন দেখা হয় তাহলে কি রোযা ভেঙে যাবে? 

উত্তর: আমার প্রশ্ন হল ঘুমের ভেতরে যদি কেউ মানুষ খুন করে তাহলে কি ফাঁসি হবে? আসলে ঘুমের ভেতরের কর্মের জন্য আপনি দায়ী নন। কোনো পাপও হবে না। রোযারও কোনো ক্ষতি হবে না। রাসূল সা. বলেছেন, ঘুমন্ত মানুষ যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে তার যা কিছু কর্ম… এমনকি ঘুমন্ত মানুষ বিছানা থেকে পড়ে একজন মানুষকে যদি মেরেও ফেলে, এই জন্যও তার কোনো পাপ লেখা হবে না।

প্রশ্নঃ আমার ৮/৯ বছরের দুইটা বাচ্চা । গত বছর রোযা রাখছিল । আমি ভেঙে ভেঙে কয়েকটা রাখতে দিয়েছিলাম । কিন্ত এই বছর একেবারেই মানে না । রমাযান এ রোযা থাকবেই । সাহরির আগ পর্যন্ত ঘৃমায়ও না। যদি না ডাকি! সাহরি খেয়ে তারপর ঘুমায় । অনেকে আমাকে বলে, এতটুকু বাচ্চার রোষা রাখাচ্ছি- এতে আমার গোনাহ হবে। আসলে এক্ষেত্রে আমার করণীয় কী?

উত্তর: প্রথম কথা আপনার কোনো গোনাহ হচ্ছে না। তবে ওদের শরীরের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে । পনেরো ঘণ্টার রোযা, ওদেরকে ছোট থেকেই অভ্যস্ত করাতে হবে । সাত বছর থেকে সালাতে অভ্যন্ত করা এবং রোযাও মাঝে মাঝে থাকলে কোনো দোষ নেই । তবে ওদের শরীরে কোনো ক্ষতি না হয়, খেয়াল রাখতে হবে। প্রচুর লিকুইড খাওয়াতে হবে । মাঝে মাঝে রাখবে মাঝে মাঝে ভাঙবে | ওরা যদি জিদ করে রাখে আর শারীরিকভাবে অসুস্থ না হয়, দিনের বেলা ক্রান্ত না হয়, দৌড়াদৌড়ি না করে তাহলে ইনশাআল্লাহ কোনো অসুবিধা নেই । আপনার কোনো গোনাহ হচ্ছে না।

প্রশ্ন: আমরা অনেক সময় মসজিদে গিয়ে দেখি তারাবীহর নামায ছয় রাকআত বা আট রাকআত চলছে। এই অবস্থায় ইশার নামায না পড়ে তো আমরা তারাবীহ পড়তে পারব না । এখন একা একা ইশার নামাষ পড়লে জামাআতের ছওয়াব পাব কি না?

উত্তর: প্রথমেই আপনি ফরয সালাত আদায় করবেন । এরপর দুই রাকআত সুন্নাত আদায় করবেন । তারপর তারাবীহতে শরিক হবেন। স্বভাবতই আপনি জামাআতের ছওয়াব পাবেন না । আর এটা যেন অভ্যাসে পরিণত না হয় । ইশার সালাত জামাআতে আদায় করা ওয়াজিব পর্যায়ের ইবাদত । জামাআত নষ্ট করলে গোনাহ হবে। তারাবীহর নামায জামাআতে আদায় করা এটা নফল সুন্নাত । ঘরে আদায় করলে গোনাহ হবে না । তাই আপনার যদি রমাযান এর তারাবীহ জামাআত ধরার আগ্রহ হয় আর ইশার জামাআত ছুটে যায়- এটা খুবই দুঃখজনক ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *