গণিত এ সংখ্যা আবিষ্কারের ইতিহাস ও সংখ্যার সাহায্যে গণনা

গণনার থেকেই বর্তমান গণিতের জন্ম । অতি প্রাচীন প্রস্তর যুগে আদিম মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল , তখনও সম্ভবতঃ এক – দুই পর্যন্ত গণনা প্রচলিত ছিল । হয়ত সে যুগে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনই ভাল করে আরম্ভ হয়নি ; তবু পদার্থের রূপ সম্বন্ধে ধারণা যে নিশ্চয়ই ছিল , তার নিদর্শন পাওয়া গেছে অনুমান পনর হাজার বছর আগেকার স্পেন ও ফ্রান্সের গুহাগাত্রে অঙ্কিত চিত্র এবং স্থানে স্থানে রক্ষিত দ্রব্য সামগ্রী আর মূর্তি থেকে । নতুন প্রস্তর যুগে মানুষ খাদ্য ‘ আহরণ ‘ থেকে ‘ উৎপাদন আরম্ভ করল ।

গণিত এ সংখ্যা আবিষ্কারের ইতিহাস

সে প্রায় দশ হাজার বছর আগেকার কথা এই যুগের মৃৎ শিল্প , কান্ঠ শিল্প ও বয়ন শিল্পের অনেক নমুনা ভূগর্ভে প্রোথিত রয়েছে । তার কতকগুলো মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে । এসব থেকে দেখা যায় , তখনই গ্রাম্য সমাজ স্থাপিত হয়ে গেছে , ধানের বা গমের গোলা , রুটি সেঁকবার উনুন কুমোরের চাকা , গাড়ীর চাকা , নৌকা এবং আবাসগৃহ নির্মাণ শুরু হয়েছে ; কিন্তু এসব ছিল স্থানিক বৈশিষ্ট্য । এক স্থানে কোনও কিছু উদ্ভাবিত হলেও সে সংবাদ সহজে অন্যত্র পৌঁছতে পারত না উদাহরণস্বরূপ বলা যায় , আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা ইউরোপের সাদা আদমি দেখবার আগে কোনও দিন গাড়ীর ঢাকা দেখেনি । তবু প্রাচীন প্রস্তর যুগের চেয়ে নতুন প্রস্তর যুগের লোক অনেক দ্রুতগতিতে উন্নতির পথে অগ্রসর হয়েছে ।  একালে গ্রামগুলোর মধ্যে পণ্যের আদান – প্রদান আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ; সুতরাং গণনার আবশ্যকতা নিশ্চয়ই অনুভূত হয়েছিল । তখনকার লোকে তামা ও কাঁসার পাত্র নির্মাণের কৌশলও শিখে ফেলেছে । 

সংখ্যার ধারণা

এ অবস্থায় অবশ্যই ভাষা গঠনও প্রয়োজন হয়েছিল কিন্তু তখনও সংখ্যার ধারণা বেশ অস্পষ্ট ছিল ; সংখ্যাগুলো সর্বদাই বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকত— যেমন পাখীটা , একজোড়া জানোয়ার এক হাঁড়ি মাছ, দুটো হাত, মানুষগুলো, অনেক গাছ , সাতটা তারা ইত্যাদি । অন্ততঃ অস্ট্রেলিয়া , আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক গোত্রই যে দুশো বছর আগেও এই অবস্থায় ছিল, সে ত প্রত্যক্ষ সত্য । মোটকথা , বস্তু-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ সংখ্যার ধারণা আরও পরে এসেছে । সংখ্যা নির্দেশক শব্দ অল্প কয়েকটি মাত্র ছিল । আরও বৃহৎ সংখ্যা -নির্দেশ প্রথমে শুধু যোগের সাহায্যে , তারপর ক্রমে ক্রমে গুণ ও যোগের সাহায্যে করা হত । দুটো অস্ট্রেলীয় গোত্রের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ।

  • মারে রিভার গোত্র : এনিয়া ( এক ), পেচেভাল ( দুই), পেচেভাল – এনিয়া (তিন ), পেচেভাল – পেচেভাল ( চার ) ।
  • কামিলা রোই গোত্র : মাল ( এক ) বুলান ( দুই ) গুলিবা (তিন ) ,বুলান – বুলান (চার ), বুলান – গুলিবা ( পাঁচ), গুলিবা – গুলিবা ( ছয়) ।

পোত – নির্মাণ ও বাণিজ্য প্রসারের ফলে সংখ্যার ধারণা ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে ওঠে । আমাদের বর্তমান দশমিক প্রণালীর গণনাতেও দেখা যায় , এক থেকে দশ পর্যন্তই আমাদের মূল সংখ্যা । এর সঙ্গে বাড়তি সংখ্যা যোগ করে বৃহত্তর সংখ্যার নাম রাখা হয়েছে । আবার দশকে একক ধরে দুই দশ (বিশ ), তিন দশ (ত্রিশ), চার দশ (চল্লিশ ) ইত্যাদি গুণিতক ব্যবহৃত হয়েছে যেমন , একাদশ (দশ আর এক ), বাইশ ( দুই আর বিশ ) , পঁয়ত্রিশ (ত্রিশ আর পাঁচ )ইত্যাদি । আবার পূর্ণসংখ্যক দশের থেকে একক ঘাটতি বুঝাতে ‘ ঊন ‘ ব্যবহার করা হয়েছে । যেমন ঊনচল্লিশ (এক কম চল্লিশ ), ঊননব্বই ( এক কম নব্বই ) ইত্যাদি । কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিশেষ করে বয়স গণনায় বা টাকার গণনায় কুড়িকে একক ধরে বৃহৎ সংখ্যার গণনার রীতিও দেখা যায় যেমন , তিন কুড়ি চার ( চৌষট্টি ) টাকা ,চার কুড়ি আট ( অষ্টাশি) বছর ইত্যাদি । 

আরো পড়ুনঃ বদমাস BODMAS নিয়ম কি সঠিক ? 

আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে গণনা

আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে গণনা – প্রণালী অনুসন্ধান করতে করতে দুই, পাঁচ , দশ কুড়ি প্রভৃতির ভিত্তিতে গণনার নিদর্শন পাওয়া গেছে । বিশেষ করে মেক্সিকোর ‘ মায়া’দের এবং ইউরোপের ‘কেল্ট’দের বিশ -ভিত্তিক গণনা উল্লেখযোগ্য । সুমারীয় ও বাবিলনীয় ষাট – ভিত্তিক গণনাও ( ২১০০ খ্রীস্ট-পূর্ব)সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । আমরা যে ‘ ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট আর ষাট মিনিটে এক ঘণ্টা’ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি , এটাও প্রাচীন মেসোপটেমীয় ( সুমারীয়+ বাবিলনীয় ) সভ্যতারই অবদান।

গণিত এ সংখ্যা আবিষ্কারের ইতিহাস ও সংখ্যার সাহায্যে গণনা

তাছাড়া , কড়া গণ্ডা ডজন কুড়ি প্রভৃতিতে আমরা ৪ , ১৬ , ১২ , ৮০ প্রভৃতির গুচ্ছ ব্যবহার করে থাকি। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জিনিসের মাপ বা গণনা সংরক্ষণের জন্য রশিতে গিরে দেওয়া , বাঁশের কঞ্চি বা কাঠে দাগ দেওয়া আঁটি বাঁধা ইত্যাদির প্রচলন ছিল । চল্লিশ – পঞ্চাশ বছর আগেও আমাদের দেশে গোয়ালের দুধের হিসাব রাখার জন্য ফাড়া কঞ্চির ব্যবহার ছিল ।দুই ভাগে ফাড়া কঞ্চি একত্র করে সংযোগ স্থলের উপর ধারাল কাচি দিয়ে দাগ কাটা হত , তারপর ক্রেতা আর বিক্রেতা দুই জনের কাছেই ওর এক এক অংশ থাকত , যাতে একজন অতিরিক্ত দাগ কেটে অপরকে ঠকাতে না পারে । ওতে সের পোয়ার হিসাব থাকত , পাঁচ সেৱ , দশ সেরেরও আলাদা চিহ্ন থাকত । এই প্রকার রীতি যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এমনকি , নতুন প্রস্তরযুগেও প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ১৯৩৭ সালে মোরাডিয়ার অন্তর্গত ভেস্টোনিস অঞ্চলে । 

দৈর্ঘ্যের মাপ

ঐ স্থান খনন করে নেকড়ের সামনের পায়ের সাত ইঞ্চি লম্বা একখণ্ড হাড় ( Radius ) পাওয়া গেছে , যাতে পঞ্চান্নটা গভীর আড়াআড়ি দাগ কাটা রয়েছে— প্রথম পঁচিশটি দাগ পাঁচ থাকে পর পর সাজান ; তারপর দুটো বড় বড় সমাপ্তি রেখা অবশিষ্ট ত্রিশটি দাগকে পৃথক করে দিয়েছে ; এরপর বাকি ত্রিশটা দাগও পাঁচ পাঁচটি করে হয় থাকে সাজান রয়েছে । এর থেকে মনে হয় , হাতের আঙ্গুল গুনতে গুনতেই যে প্রথম গণনার সূত্রপাত হয়েছে , তা ঠিক না – ও হতে পারে । 

কারও কারও মতে , হাতের আঙ্গুল গুনে সংখ্যার হিসাব , কোনও বিশেষ সামাজিক অবস্থায় আরম্ভ হয়েছিল । দশ এবং পাঁচের গুণ ও যোগ -বিয়োগের সাহায্যে সংখ্যা গণনার এই দ্বৈধ দৃষ্টান্ত কয়েক হাজার বছর ধরে প্রাচীন মিসর এবং সিন্ধু নদের অববাহিকা মহেঞ্জোদারোতে চালু ছিল ।

দৈর্ঘ্যের মাপে হাত , ফিট ( পা ) , রশি , অঙ্গুলি , নল ( পোল ) সুত ( সুত্র , সুতা ) প্রভৃতির সঙ্গে কৃষিকার্য গৃহ নির্মাণ , বস্ত্র- বয়নের সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায় ওজনের মাপে গ্রাম ( ছোলা ) , তিল , রতি ( কুঁচের ওজন ) মেন ( দানা ) আয়তনের মাপে সের ( পাত্র বিশেষ ) , কাঠা ( পাত্র বিশেষ ) মৌটি (তৈলাদি মাপক হাতলওয়ালা ক্ষুদ্র বাটি ) প্রভৃতির সঙ্গে ব্যবহারিক সম্পর্ক রয়েছে । এই পরিমাণগুলো নিয়েই পরিমিতির প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল ।

ম্যাজিক সংখ্যা

ইতিপূর্বেই মৃৎ -শিল্প এবং মূর্তি সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে , এর থেকে দেখা যায় , প্রতিসাম্য সাদৃশ্য ও সর্বসমতার সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্পর্কের কথা সুদূর অতীতেই লোকের মনে উদয় হয়েছে অতীত যুগের ধর্মীয় উৎসব ও চিকিৎসাদি ব্যাপারে টোটকা , তাবিজ ; যুদ্ধ প্রভৃতির ভিতর দিয়ে স্বস্তিক , ক্রুশ ত্রিভুজ , চতুর্ভূজ , পঞ্চফলক এবং ১ ৩ , ৫ , ৭ , ৯ প্রভৃতি ম্যাজিক সংখ্যার প্রতিও মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল ।

অতি প্রাচীনকাল থেকেই চন্দ্র , সূর্য , তারকাদির গতি লক্ষ্য করে সময় নির্ধারণের চেষ্টা চলছিল। খেত – খোলা এবং ব্যবসায় – বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এগুলো বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে পড়ল । মানবেতিহাসের অনেক গোড়ার দিকেই চান্দ্র বার্ষিক পঞ্জিকার প্রচলন দেখা যায় । আদিম যুগের মানুষও উত্তরায়ণ দক্ষিণায়ন ও সপ্তর্ষি মণ্ডলের আবির্ভাব স্থান লক্ষ্য করে বৎসরের ঋতু নির্ণয় করতে পারত । কোনও কোনও দেশের লোক নক্ষত্রমণ্ডলী লক্ষ্য করে সমুদ্র পথে দিক নির্ণয়ে দক্ষতা অর্জন করেছিল । এইসব নাক্ষত্রিক পর্যবেক্ষণ থেকে গোলকের উপরকার কৌণিক দূরত্ব এবং ক্ষুদ্র বৃত্ত ও বৃহৎ বৃত্তের ধারণার প্রথম উদ্ভব হয় ।

About admin

Check Also

৪৫ তম বিসিএস প্রস্তুতিঃ নির্বাচিত বইয়ের তালিকা। 45 BCS Preparation Book List 2022

৪৫ তম বিসিএস প্রস্তুতিঃ নির্বাচিত বইয়ের তালিকা। 45 BCS Preparation Book List 2022

বিসিএস ক্যাডার, পররাষ্ট্র ক্যাডার, কাস্টমস ক্যাডার এবং পুলিশ ক্যাডারের মতো পূর্ববর্তী শীর্ষ বিসিএস ক্যাডার এর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *